আজ মঙ্গলবার, ২রা ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১১ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি
আজ মঙ্গলবার, ২রা ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১১ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

স্বপ্নবিলাষী এলোমেলো সরকার এবং হাতী-গাধা ও ফ্লাইং কিস প্রসঙ্গ

স্বপ্ন দেখতে কে না ভালবাসে? নতুন বাংলাদেশ গঠনে আমাদের অনেক স্বপ্ন-সাধনার সরকারও তাই স্বপ্নের ঝাঁপি খুলে বসেছে। বলছে, তারা নাকি এবার সবকিছু সংস্কার করবেই করবে। এখানে কোনো বৈষম্য থাকবে না। সকল নাগরিক ভোগ করবে সমান অধিকার। থাকবে না কোনো অনাচার-অত্যাচার। প্রতিষ্ঠিত হবে আইনের শাসন। পুলিশ হবে জনগনের বন্ধু। প্রশাসনের কর্মচারীরা হবে মানুষের সেবক। রাষ্ট্রের সংবিধান হবে জনতার। দেশটা হবে শান্তি-সুখময়। আহা কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে!

 

সরকারের সংস্কারের বয়ান শুনে ছোট বেলার একটি স্মৃতি মনে পড়ে গেল। মাঝে-মধ্যে আব্বার সঙ্গে সাপ্তাহিক হাট-বাজারে গেলে কিছু কথা নিয়মিত শুনা যেত। জনৈক ক্যানবাসার মাইকে বলতো, ‘যাদের শরীর সারাক্ষণ চাবায়-কামড়ায়,গীরায়-গীরায় ব্যথা। যারা পিঠ ব্যথা,পেট ব্যথা,মাথা ব্যথা,হাটু ব্যথা, কোমর ব্যথায় ভুগছেন। তারা আমাদের মাইকের কাছে চলে আসুন। মাত্র ২ টাকার মলমে সকল ব্যথা,চুলকানি-কাউযানি চিরদিনের জন্য ভাল হয়ে যাবে। শুধু একবার ব্যবহার করে দেখুন। যাদের সারা শরীরে কাউযানি। চিপায়-চাপায় কাউযানি। নাভীর নিচে কাউযানি। কাউযাইতে কাউযাইতে চামড়া চিল্লা ফালাইছেন। হায়রে মজার কাউযানি! মনে হয় মরন চান্দের রসগোল্লা’!

 

আরেক ক্যানবাসার বলতো, ‘চিকন থেকে যারা মোটা হতে চান। হাজার হাজার টাকার ওষুধ খেয়েও সুফল পাচ্ছেন না। সামান্য পরিশ্রমেই হাপিয়ে ওঠেন। বউয়ের কাছে যেতে ভয় পান। তারা একবার ‘কুমিল্লার পলি টনিক’র একটি ফাইল খেয়ে দেখুন। দাম মাত্র ১০ টাকা…। একটা খেলে বার বার খেতে মন চাইবে। শরীর হবে তরতাজা-মোটা। শক্তি পাবেন বাঘের মতো। বউ বলবে….’(প্রকাশযোগ্য মনে করছি না)।
এমন বিচিত্র ও চমকদার ক্যানবাসারদের ঘিরে উৎসুক জনতার কমতি ছিলনা মোটেও। বোধ করি মানুষ এখন আর এসবে বিশ্বাস করে না।

 

ফ্যাসিস্ট হাসিনা গত সাড়ে ১৫ বছরে যে জঞ্জাল তৈরি করেছেন। তা সারাতেই কমপক্ষে সাড়ে ১৫ বছর দরকার বলে আমি মনে করি। কাজেই আপনারা ক’বছর রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন। আগে সেটা পরিষ্কার করুন। কামোখা স্বপ্ন দেখিয়ে লাভ কী? পাঠক,এখানে ভারতের জগজিৎ সিং’র একটি গান’র কয়েকটি লাইন উল্লেখ না করে পারছি না।
বেশী কিছু আশা করা ভুল
বুঝলাম আমি এতদিনে।
মুক্তি মেলে না সহজে..।
এই জগতে এমনও লোক থাকে
স্বপ্ন দেখতে নেই যাদের ।

তাই বলব, সংস্কার যদি করতেই চান, তবে এমপিদের শুল্কমুক্ত গাড়ী আমদানি স্থয়ীভাবে বন্ধ করুন। রাজধানীসহ সবখানে ময়লা বাণিজ্য বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিন। সবক্ষেত্রে গোপন চাঁদাবাজি বন্ধ করে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য আমেরিকার মত প্রকাশ্যে চাঁদা প্রথা চালু করুন। তাহলেই মানুষ আপনাদেরকে আজীবন মনে রাখবেন। দোয়া করবেন।

 

চারপাশে বহুমাত্রিক বৈষম্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। দৃশ্যমান দুর্নীতি কমলেও সরকারের কাজের গতি থেমে গেছে। হয়রানি দুর্নীতির চেয়েও ভয়াবহ রুপ লাভ করেছে। ছিনতাইকারীর দাপটে মানুষ রাস্তায় চলতে ভয় পাচ্ছে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে সরকারের চরম গাফিলতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। জননিরাপত্তা ও জনপ্রত্যাশা পূরণের চেয়ে কাগুজে সংস্কার নিয়ে সরকারকে বেশী ব্যস্ত মনে হচ্ছে।

 

সার্বিক প্রেক্ষাটে মনে হচ্ছে সরকার এবার কোমর বেঁধেই মাঠে নামছে। নজির বিহীন এক অধ্যাদেশ জারি করতে চলেছে সরকার। অধ্যাদেশের বিষয়-বস্তু আমাদেরকে ভাল কোনো পূর্বাভাস দিচ্ছে না।

খসড়ায় উল্লেখ করা হযেছে যে,‘অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ হবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ গঠিত হওয়ার পর নতুন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব নেওয়ার দিন পর্যন্ত। আর অন্তর্বর্তী সরকার গঠন, সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বা কোনো উপদেষ্টার নিয়োগে কোনো ত্রুটি থাকলে শুধু এ কারণে তাঁদের কোনো কাজ অবৈধ হবে না। এ সম্পর্কে কোনো আদালতে কোনো প্রশ্নও তোলা যাবে না। এমনকি মামলাও করা যাবে না।’
এমন বিধান রেখে চূড়ান্ত করা হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার অধ্যাদেশের খসড়া। গত ১৯ সেপ্টেম্বর খসড়াটি উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অনুমোদন দেওয়া হলেও এখনো অধ্যাদেশ আকারে জারি হয়নি। তবে এটা যে কোনো সময় জারি করা হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

 

লক্ষ্য করবেন,আমার আগের লেখায় দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এবং নির্বাচন নিয়ে যে ইঙ্গিত দিয়েছিলাম। এই অধ্যাদেশের মধ্য দিয়ে তাই সত্যি হতে চলেছে।

 

এই পরিস্থিতিতে দেশের গণতন্ত্রে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলগুলোর সুদৃঢ় ঐক্য খুবই জরুরী বলে আমি মনে করি। বিশেষ করে বিএনপিকে এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। কালক্ষেপন না করে বিএনপির উচিৎ এখনই শক্ত অবস্থান ব্যক্ত করা। যদিও বিএনপি শুরু থেকেই সরকারের কাছে নির্বাচনী রোডম্যাপ চাইছে।

 

কিন্তু সরকার যেহেতু এখন কৌশলগত শক্ত অবস্থান নিয়ে নিয়েছে। তাই বিএনপিকেও দ্রæত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নির্বাচনী রোডম্যাপ’র জন্য প্রয়োজনে চূড়ান্ত আল্টিমেটাম ঘোষণা করতে হবে। তা নাহলে বিএনপিকে চড়া ম্যূল্য দিতে হতে পারে।

 

বিএনপিকে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, সরকারের ৩ মাসের মধ্যে ড.ইউনুসের সঙ্গে মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তারা অন্তত ৩ বার এবং সহকারী পরারাষ্ট্র মন্ত্রী ডোনাল্ড লু বৈঠক করে গেছেন। এছাড়া জাতিসংঘ,বৃটিশ এবং ই.ইউ প্রতিনিধিরাও নিয়মিত দেখা সাক্ষাৎ করছেন। কিন্তু নির্বাচন প্রশ্নে তারা একদমই চুপ। গনতন্ত্র ও মাবাধিকারের ফেরিওয়ালাদের এমন নীরবতা মোটেও ভাল লক্ষন নয়।

 

এই সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা ছিল খুবই সামান্য। ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের পর জিনিস-পত্রের দাম কমবে। চাঁদাবাজি-হয়রানি বন্ধ হবে। জীবনযাত্রা একটু সহজ হবে। বাস এটুকুই। তাতেই মানুষ ড.ইউনুস এর সরকারকে ধন্য ধন্য করতো। কিন্তু ফল হলো উল্টো। এতদিন সাধারণ মানুষের সম্বল ছিল আলু ভর্তা আর পাতলা ডাল। এখন তিন বেলা তাও যোগার করতে পারছে না অনেকে। কারণ, আলুর কেজি ৭০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। আলু ভর্তা-ডাল রান্নার প্রধান অনুষঙ্গ পেঁয়াজ-কাঁচা মরিচের দামও বেজায় চড়া। মোটা চালের দামও বাড়তির দিকে।

 

দাবি পার্টির উৎপাতে জনজীবন অতিষ্ট। যখন তখন রাস্তা বন্ধ করে বিক্ষোভের ফলে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে অগনিত মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। নতুন চাকরী মিলছে না তেমন। উপরন্তু অনেকের চাকরী চলে যাচ্ছে ঠুনকো অজুহাতে। আওয়ামীপন্থী ব্যবসায়ী গ্রæপের কর্মীরা বেতন পাচ্ছে না ঠিক মতো। যারা বেতন দিচ্ছে তারাও কাটছাট করে দিচ্ছে। অজুহাত হিসেবে তারা বলছে, সরকার কোম্পানির একাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছে।

 

এ ব্যাপারে সরকারকে বলব, ভুল পথে পা বাড়াবেন না। কোম্পানির একাউন্ট বন্ধ করে থাকলে দ্রæত খুলে দিন। অপরাধ থাকলে মালিককে ধরে শাস্তি দিন। কারণ, কোম্পানি ও কর্মীদের কোনো দায় নেই। তাদের পরিবার-সংসারের কথা একবার ভাবুন। তারাও হাসিনার পতনে কোনো না কোনোভাবে ভূমিকা রেখেছে। আর তা নাহলেও তারা আমাদের মতোই দেশের নাগরিক। ভিন্ন মত ও পথের হলেই কাউকে বিনা কারণে হয়রানি-বঞ্চিত করা হাসিনার নীতি থেকে আপনারা ফিরে আসুন। আপনারা যে হাসিনার থেকে ভাল তা শুধু কথায় নয় কাজ দিয়ে প্রমাণ করুন।

 

অনেক ব্যর্থতার মধ্যেও সরকারের একটি অসাধারণ সাফল্যের কথা আমাকে বলতেই হবে এখানে। কাল বিমান বন্দরে প্রবাসীদের জন্য বিশেষ লাউঞ্জ উদ্বোধন করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড.মোহাম্মদ ইউনুস। বিদেশে যাওয়া আসার ক্ষেত্রে এতদিন বিমান বন্দরে প্রবাসীদের হয়রানির অন্ত ছিল না। কিন্তু অতীতে কোনো সরকারই প্রবাসীদের হয়রানি বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি। এ জন্য সরকারকে আন্তরিক মোবারকবাদ জনাই। মাত্র ৩ মাসের মধ্যে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কল্যাণে কাজটি সম্পন্ন করে এ ক্ষেত্রে সরকার তার সদিচ্ছার স্বক্ষর রেখেছেন বলে আমি মনে করি।

 

যে কোনো বিচারে সাধারণ মানুষকে একটু স্বস্তি দেয়ার বিষয়টি সরকারের মনোযোগের কেন্দ্রে থাকা উচিৎ ছিল। কিন্তু সরকারের সমস্ত মনযোগ এখন সংস্কারে। ফলে সিকি বছরের এই সরকারের প্রতি জনসমর্থন ক্রমশ কমছে। অপরদিকে দীর্ঘ হচ্ছে জনতার অভিযোগের খতিয়ান। কারণ, সরকার একদিকে সউল্লাসে জনগণের মাঝে স্বপ্ন ফেরী করে বেরাচ্ছে। অন্যদিকে নিজেরাই এলোমেলো আচরণ করছে। বৈষম্যবিরোধী উর্দি গায়ে সরকার পুলিশ-জনপ্রশাসন তথা সর্বত্র বৈষম্যের ষোলকলা পূরণ করছে। বৈষম্যই যেন সরকারের প্রধান অলংকার হয়ে ওঠেছে।

 

অন্তর্র্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদই বৈষম্যের বড় দৃষ্টান্ত। ২৪ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদের ১৩ জনই চট্টগ্রাম বিভাগের। অন্যদিকে বীর শহীদ সাঈদ’র স্মৃতি বিজরিত রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের কেউ নেই উপদেষ্টা পরিষদে।

 

বৈষম্যের আরেকটি উদাহরন দেয়া যাক। ২০২২ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের তদানীন্তন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাতে আবারও ক্ষমতায় আসেন এবং আ.লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থীর জয় চেয়ে মোনাজাত করেন। হাসিনার জন্য জন্য বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর দোয়া করা উচিত বলেও মন্তব্য করেছিলেন। পুরস্কার হিসেবে তাকে ঢাকা জেলা প্রশাসক করেছিল হাসিনা সরকার। ইউনুস সরকার এসে তাকে ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার করে (অতিরিক্ত দায়িত্বে)। সম্প্রতি তাকে মন্ত্রণালয়ে বদলী করা হয়েছে। আর তার ভাগিনা তানভীর আহমেদকে ঢাকা জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে সরকার। অবশ্য মোনাজাতকান্ড ছাড়া মমিনুর রহমানের বিরুদ্ধে অন্য কোনো অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠেনি।

 

শোনা যাচ্ছে, দক্ষ-সৎ কর্মকর্তার অভাবে নাকি সরকার কাজ করতে পারছে না। এ জন্য তারা উন্নত মানের কর্মকর্তা তালাশ করছে।

 

অন্যদিকে সাবেক ঢাকা জেলা প্রশাসক শহীদুল ইসলাম, যিনি একজন দক্ষ ও পেশাদার কর্মকর্তা হিসেবে সর্বজনবিদিত। যে কোনো সেবাপ্রার্থীর সঙ্গে সদাচারণের জন্যও তার খ্যাতি রয়েছে। অথচ তাকে ওএসডি করা হয়েছে। তার অপরাধ, তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চাকরী করেছেন। পক্ষান্তরে তার চেয়েও কয়েকগুণ বেশী সময় ধরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে চাকরী করেও অনেকে এখন ইউনুস সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ডেস্কে কাজ করছেন।

 

তাই সরকারের কাছে আমার প্রশ্ন, শহীদুল ইসলামের পুরো ক্যারিয়ারে কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি ও অসদাচরণের তথ্য কি আপনাদের কাছে রয়েছে? থাকলে তা আমাদের সামনে প্রকাশ করুন। আর তা নাহলে অবিলম্বে তার মতো সকল পেশাদার কর্মকর্তার ওএসডি প্রত্যাহারের জন্য জোর দাবি জনাচ্ছি। এমন বৈষম্যের অনেক তথ্য আমাদের হাতে আছে।

 

অপরদিকে আইন শৃংখলার দিকে মনেনিবেশ না করে পুলিশের মধ্যে এখনো চলছে গ্রæপিং-লবিং। মারাত্মক পর্যায়ে চলে গেছে অভ্যন্তরীন কলহ। আইজিপির সামনেই মারামারিতে লিপ্ত হচ্ছে পুলিশের কর্তারা। গণমাধ্যমে এক পক্ষ আরেক পক্ষের বিরুদ্ধে বদনাম ছড়াচ্ছে। জ্ঞান-গরিমা এবং প্রশ্নাতীত সততা-দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের জন্য খ্যাতি রয়েছে এমন কর্মকর্তাদের নামেও ভিত্তিহীন খবর প্রচার করা হচ্ছে। অর্থাৎ পুলিশ ও জনপ্রশাসন আটকে গেছে শক্তিশালী দুষ্টু চক্রে।

 

অসংলগ্নতা যেন এই সরকারের পিছু ছাড়ছেই না। নির্বাচন প্রশ্নে কতিপয় উপদেষ্টা ও সমন্বয়ক শীর্ষ রাজনৈতিক দল ও সংখ্যাঘরিষ্ঠ মানুষের দাবির প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বক্তব্য রাখছেন। বলছেন, ‘আগে সংস্কার তারপর নির্বাচন। শুধু নির্বাচনের জন্য ২ হাজার মানুষ প্রাণ দেয়নি’। তারা অগ্রজদের ব্যর্থ বলে আখ্যায়িত করছেন। কী ভয়ংকর কথা। তাদের এসব বক্তব্যের মধ্যেই যে চরম স্বৈরাচারী মনোভাব ফুটে ওঠছে। তা কী তারা বুঝতে পারছেন?

 

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজই হচ্ছে নির্বাচন আয়োজন করা। এটা দুনিয়াব্যাপী স্বীকৃত। একটি অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য যতটুকু সংস্কার দরকার। অন্তর্বর্তী সরকার ঠিক ততটুকু সংস্কারই করবেন। এর বেশী একটুও নয়।

 

সংস্কার প্রশ্নে কতিপয় উপদেষ্টা ও সমন্বয়ক কথায় কথায় জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদ ও আহত বীর সেনানীদের প্রসঙ্গ টানছেন। যা পতিত স্বৈরাচার আ.লীগের ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ নিয়ে ভন্ডামীর মতো লাগছে। অথচ সরকারের প্রতি অভ্যুত্থানে আহতদের অভিযোগই সবচেয়ে বেশী। হাত-পা ও চোখ হারানো মানুষগুলোর সামনে কেবলই অমানিষার অন্ধকার। অর্থাভাবে আহতদের সকরুণ অবস্থা। পক্ষান্তরে সমন্বয়কদের হাতে স্যামসাং এস-২৪ মডেলের মোবাইল ফোন। যার মূল্য দেড় লক্ষ টাকার ওপরে। গায়ে দামি ব্র্যান্ডের জামা। পাঠক কী বুঝলেন?

 

এদিকে আচার-আচরণ ও স্বভাব চরিত্রে যথেষ্ঠ মিল থাকায় অনেকে এ সরকারকে আ.লীগের বি.টীম মনে করছে। আ.লীগকে পুনর্বাসনে সরকার গোপনে কাজ করছে বলেও গুঞ্জন ওঠেছে। মানুষ বলাবলি করছে যে,ফ্যাসিস্ট হাসিনার সহযোগী ইনু-মেনন জেলে থাকলে জিএম কাদের-চুন্নুরা এখনো বাইরে কেন? এক যাত্রায় দুই ফল হয় কী করে?

 

স্মরণ করা যেতে পারে যে, ৫ আগস্ট হাসিনা ভারতে পালানোর পর আ.লীগ গর্তের অনেক গভীরে ঢুকে গিয়েছিল। কিন্তু ইউনুস সরকারই অবিশ্বাস্যভাবে তাদেরকে হ্যাচকা টানে রাজনীতির মাঠে নিয়ে এসেছেন। এ সরকার শপথ নেয়ার পরপরই তখনকার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত প্রথম ব্রিফিংয়েই হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে বলেন যে, ‘আপনাকে আমরা শ্রদ্ধা করি। আপনি আসুন। এসে দল গোছান। কিন্তু গন্ডগোল করবেন না’। এর কিছুদিন পর আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল আ.লীগকে নিষিদ্ধকরণ প্রশ্নে বলেন,‘আ.লীগ একটি ঐতিহ্যবাহী দল। এ দলের অনেক অবদান আছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে’।

 

সরকারের দু’জন প্রভাবশালী উপদেষ্টার এমন বক্তব্যের পর পরই ভীত-সন্ত্রস্ত আ.লীগ কর্মীরা অপরিসীম শক্তি-সাহস ফিরে পায়। সামাজিক মাধ্যমে সরব হতে শুরু করে। অন্যদিকে কয়েক ডজন ডাউস আকারের সুটকেস ভরা ডলার নিয়ে ভারতে পালানো হাসিনা চট করে দেশে ঢুকে যাবেন বলে প্রথম অডিও প্রকাশ পায় ১৩ সেপ্টেম্বর। আ.লীগ এর প্রতি উপদেষ্টাদ্বয়ের এমন গভীর প্রেমের অসংকোচ প্রকাশের পেছনে যে রাজনীতি ও ষড়যন্ত্র লুকিয়ে আছে তা এখন স্পষ্ঠ হতে শুরু করেছে।

 

খুনি হাসিনার চিহ্নিত দোসররাও এখন উপদেষ্টা হচ্ছেন। পজিটিভ প্রেমের চেয়ে নেগেটিভ প্রেম যে কখনো শক্তিশালী হয়। এ ঘটনা তারই বড় প্রমাণ। তবে আমি মনে করি, পর্দার অন্তরালে যত খেলাই হোক না কেন। হাসিনার ক্ষমা প্রার্থনা ও ফ্যাসিস্টদের বিচার ছাড়া কোনো ধরনের রাজনৈতিক বন্দোবস্ত এদেশের মানুষ মানবে না।

 

পাঠক আরেকটি বিষয় এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই। নিশ্চয় আপনারা দেশের শিক্ষার্থীদের কর্মকান্ডের দিকে লক্ষ্য রাখছেন। প্রকৃতপক্ষে ছাত্র সমাজ ও তরুনদের শরীরি ভাষা ও মনোজগতে যে পরিবর্তন দেখছি। তা আমাকে শংঙ্কিত করে তুলছে। অনেক ক্ষেত্রেই কোমলমতি শিক্ষার্থী-সমন্বয়করা নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। যখন তখন যাকে তাকে লাঞ্ছিত করা,পদত্যাগে বাধ্য করা যেন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে।

 

হাসিনার পতনে ছাত্ররা অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে বলে ‘ছোটদের প্রতি ¯েœহ এবং বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা’ প্রদর্শনের সামাজিক অনুশাসন আমরা ছুরে ফেলে দিতে পারি না। এ বিষয়ে সমাজের সবাইকে এখনই এগিয়ে আসতে হবে। সহসা তাদেরকে রাজপথ থেকে পূর্বের ন্যয় শিক্ষা-পাঠে ফেরাতে না পারলে দীর্ঘ দিনের সামাজিক কাঠামো ভেঙ্গে পড়তে পারে। এজন্য জাতিকে চরম মূল্য দিতে হতে পারে।

সাময়িক ক্ষমতার মোহে অথবা বিদেশী প্রভুদের ইন্ধনে ছাত্র সমাজ ও ইসলামিষ্টদের ব্যবহার করার প্রবণতা ক্রমশ স্পষ্ঠ হয়ে ওঠছে। কয়েকটি ইসলামী দল এবং সরকারের নিয়োগ কর্তারা সংস্কার ও নির্বাচন প্রশ্নে একই সুরে কথা বলছে। এ বিষয়ে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।

 

আপনারা নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন যে, গেল দুর্গাপূঁজায় ইসলামের ঝান্ডাধারী কতিপয় হুজুর কি অপূর্ব খসরতই না আমাদের দেখিয়েছেন। আমাদের বড় হুজুররা এখন ফ্লাইং কিস দিচ্ছে! কেউ দুর্গাপূঁজার মন্ডপে গিয়ে নেচেছে! হিন্দুদের মন্ত্র পাঠ করেছে! গান গেয়েছে! এসব মোটেও শুভ লক্ষন নয়। কথায় আছে, ‘অতি ভক্তি চোরের লক্ষন’। এসব বিষয়ে পরের লেখায় বিস্তারিত বলব, কথা দিচ্ছি। আজ শুধু এটুকু বলতে চাই যে, ধর্মের নামে কোনো ভন্ডামী এদশের মানুষ বরদাশত করবে না। আমরা ইসলামের সৌন্দর্যকে মাথার মুকুট করে সব ধর্মের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাব। আমাদের প্রিয় এই দেশকে ইরাক,ইরান,লিবিয়া,মিশর কিংবা আফগানিস্তান বানানোর যে কোনো ষড়যন্ত্র দেশপ্রেমিক কোটি জনতা রুখে দেবে ইনশাল্লাহ।

 

অনেকতো কথা হলো। এবার হাতী-গাধার প্রসঙ্গ বলে শেষ করা যাক। সরকারেকে বলব, মূলবান সময় ব্যয় করে আপনারা হাতী ও গাধার কথা একটু ভাবুন। ৫ নভেম্বর দুপুর পর্যন্ত গাধাকেই এগিয়ে রেখেছিল বিভিন্ন জরিপ,সকল মিডিয়া ও পুরো দুনিয়া। কিন্তু কিছু সময় পর দেখা গেল,গাধা ল্যান্ডমার্কে পৌঁছার অনেক আগেই মুখ থুবরে পড়ল। মার্কিনীরা রায় দিল হাতীর পক্ষে। যৌন কেলেঙ্কারি থেকে ফৌযদারি অপরাধ এবং উন্নাসিক মানসিকতা ও মিথ্যাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত। তবুও ১৩০ বছরের রেকর্ড ভেঙ্গে হাতীর বিক্রম বিজয় প্রতক্ষ্য করল গোটা বিশ্ব। এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। এ থেকে আমরা সকলেই শিক্ষা নিতে পারি।

 

সুতরাং এ দেশের সরলপ্রাণ মানুষকে অহেতুক স্বপ্নের ভেলায় না ভাসিয়ে দ্রæত একটি নির্বাচন দিয়ে আপনারা সম্মান নিয়ে ঘরে ফিরে যান। এতেই সকলের মঙ্গল।-লেখক: সাংবাদিক,ঢাকা।

ahabibhme@gmail.com

 

 

 

 

 

শেয়ার করুন
Share on Facebook
Facebook
Pin on Pinterest
Pinterest
Tweet about this on Twitter
Twitter
Share on LinkedIn
Linkedin