আজ বুধবার, ৩রা ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১২ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি
আজ বুধবার, ৩রা ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১২ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

ভূমিকম্প-করোনা: রক্তের সম্পর্কের চেয়েও বড় নৈতিকতা

 

 

শুক্রবারের ভূমিকম্পে দেশের বিভিন্ন স্থানে মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যে দুলতে থাকা ভবন, কাঁচ ভাঙার শব্দ, মানুষজনের ছুটোছুটি—সব মিলিয়ে তৈরি হয় আতঙ্কের পরিবেশ।

এমন এক সময়ে দুটি ভিন্ন দৃশ্য আমাদের সামনে প্রকাশ পায়—দুটি ঘটনা, দুটি আচরণ, কিন্তু এক গভীর মানবিক প্রশ্নের সামনে জাতিকে দাঁড় করিয়ে দেয়: রক্তের সম্পর্ক কি সত্যিই সবচেয়ে বড়? নাকি নৈতিকতাই মানুষের প্রকৃত পরিচয়?

ঘটনাটি রাজধানীর এক সুপারশপে। ভূমিকম্প শুরুর ঠিক মুহূর্তে দোকানের ভেতরে এক পিতা তার ছোট সন্তানের সঙ্গে কেনাকাটা করছিলেন। হঠাৎ দুলুনি অনুভূত হতেই তিনি আতঙ্কে দৌড়ে বেরিয়ে যান। কিন্তু তার শিশু সন্তানটি রয়ে যায় দোকানের ভেতরেই—অসহায়, বিমূঢ় শিশুটিও পরে দৌড়ে বের হয়ে যায়।

সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, পিতা নিজের প্রাণ রক্ষার তাড়নায় বেরিয়ে গেলেও সন্তানের কথা ভাবতে পারেননি। এই দৃশ্যটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে জনমনে তীব্র আলোচনার জন্ম দেয়।

একজন পিতা—যার পরিচয় সাধারণত নিরাপত্তা, স্নেহ ও আশ্রয়ের প্রতীক—তিনি বিপদের মুহূর্তে সন্তানের চেয়েও নিজের নিরাপত্তাকে বড় মনে করলেন। এক্ষেত্রে সমাজবিজ্ঞানীদের ভাষ্য হচ্ছে, এমন আচরণ যদিও ভয় বা আতঙ্কের মুহূর্তে ঘটতে পারে।

তবু এটি একটি বেদনাদায়ক প্রশ্ন তোলে—কেবল রক্তের বন্ধনই কি সম্পর্কের শক্তি নিশ্চিত করতে পারে?

অন্যদিকে রাজধানীর একটি মাদ্রাসায় দেখা যায় সম্পূর্ণ বিপরীত দৃশ্য। ভূমিকম্পের সময় শিক্ষক তার চারপাশের শিক্ষার্থীদের বুকে জড়িয়ে ধরেন। তিনি মাথার ওপর কোল বালিশ ধরে বাচ্চাদের সম্ভাব্য আঘাত থেকে রক্ষার এবং নিরাপদে বের করে আনার চেষ্টা করেন। নিজের নিরাপত্তার কথা এক মুহূর্তও ভাবেননি।

সিসিটিভি ফুটেজে শিশুদের দিকে তার শরীর ঝুঁকে থাকা, হাত দিয়ে শিক্ষার্থীদের ঢেকে রাখা—এসব দৃশ্য মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে।

একদিকে এক পিতা নিজের সন্তানকে ফেলে দৌড়ে যাচ্ছেন, অন্যদিকে একজন শিক্ষক জীবন বাজি রেখে শিক্ষার্থীদের রক্ষা করছেন—এই দুই চিত্রই শুক্রবারের ভূমিকম্পে ফুটে ওঠে।

এ দুটি আচরণ তুলনা করলে আমাদের সামনে নতুন করে প্রশ্ন উঠে আসে—আসল সম্পর্ক কোথায়? রক্তের বন্ধনে, নাকি মানবিক নৈতিকতায়?

সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, “বিপদের সময় মানুষের প্রকৃত মুখোশ খুলে যায়। সেখানে প্রকাশ পায় তার চরিত্র, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা।” শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষ বিশ্বাস করে এসেছে রক্তের সম্পর্কই সবচেয়ে শক্তিশালী। সন্তানকে পিতা-মাতা, কিংবা ভাই-বোন—এই সম্পর্কগুলো গভীর ও আবেগপূর্ণ। কিন্তু বাস্তবতা এর চেয়ে জটিল। নানা সময়ে দেখা গেছে, বিপদের মুহূর্তে অনেকে নিজের স্বার্থকে প্রাধান্য দেন, এমনকি কাছের মানুষকেও ফেলে চলে যান।

করোনাকালেও আমরা এ ধরনের বহু ঘটনার সাক্ষী হয়েছি। হাসপাতালে বাবা-মাকে রেখে চলে যাওয়া সন্তান, মৃতদেহ নিতে অস্বীকৃতি, অসুস্থ সদস্যকে আলাদা ঘরে বন্ধ করে রাখা—এসব স্মৃতি এখনও সমাজকে নাড়িয়ে দেয়। আবার একই সময়ে অনেক মানুষ—চিকিৎসক, স্বেচ্ছাসেবক, প্রতিবেশী—নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অন্যের পাশে দাঁড়িয়েছেন।

অর্থাৎ, সম্পর্কের গভীরতা কেবল রক্তে নয়; মানবিক নৈতিকতায়। যে মানুষটির মধ্যে মূল্যবোধ, সাহস, দায়িত্ববোধ ও করুণা আছে, তার কাছে মানুষ নিরাপদ। আর যিনি নৈতিক দায়বদ্ধতা অনুভব করেন না, তিনি যত ঘনিষ্ঠ সম্পর্কই রাখুন—তার কাছে কেউই প্রকৃত নিরাপত্তা পায় না।

শুক্রবারের ঘটনাগুলো সমাজকে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দিয়েছে যে, বিপদের মুহূর্তে যে আচরণ প্রকাশ পায়, সেটিই বলে দেয় তার মূল্যবোধ কতটা সুসংহত।

অন্যদিকে মাদ্রাসার শিক্ষক যেভাবে শিক্ষার্থীদের আগলে রেখেছেন, তা নিঃসন্দেহে মানবিকতার সর্বোচ্চ উদাহরণ। তার আচরণ প্রমাণ করেছে—রক্তের সম্পর্ক নয়, নৈতিকতা মানুষের আসল শক্তি। বাচ্চাগুলো তার রক্তের সন্তান নয়, কিন্তু তিনি তাদের রক্ষার জন্য নিজের ঝুঁকি নিতে দ্বিধা করেননি। কারণ তিনি সম্পর্কের শক্তির চেয়ে চেয়ে মানবিক দায়িত্ব ও নৈতিকতাকে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দিয়েছেন।

বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতা প্রমাণ করেছে—মায়া, মমতা, সাহস, দায়িত্ববোধ—এসবই সম্পর্ককে সত্যিকারের সম্পর্ক করে তোলে। কাগজে-কলমে রক্তের সম্পর্ক যতই শক্ত হোক, নৈতিকতার অভাবে তা ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। আবার নৈতিকতার ভিত্তিতে তৈরি সম্পর্ক—শিক্ষক-শিক্ষার্থী, বন্ধু, প্রতিবেশী, সহকর্মী—বিপদের দিনে আশ্রয়ের মত পাশে দাঁড়ায়।

ভূমিকম্প ও করোনা—দুই সময়ই সমাজকে একই শিক্ষা দিয়েছে:
যে সম্পর্কের ভিত্তি নৈতিকতা, সেই সম্পর্কই দীর্ঘস্থায়ী, নিরাপদ ও বিশ্বাসযোগ্য।

ঘটনাগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়—অন্যকে রক্ষা করার দায়বোধই মানুষের প্রকৃত পরিচয়। রক্তের সম্পর্ক সম্মানযোগ্য, আবেগময়—কিন্তু নৈতিকতা ছাড়া সেটি নিরাপত্তাহীন। আর নৈতিকতাসম্পন্ন মানুষ—সে শিক্ষক, প্রতিবেশী কিংবা অপরিচিত যেই হোক—বিপদের সময় আশ্রয় হয়ে ওঠে।

শুক্রবারের দৃশ্য দুটি তাই শুধু দুটি ঘটনা নয়, একটি সামাজিক আয়না। সেখানে প্রতিফলিত হয়েছে—আমরা কেমন মানুষ হতে চাই, কী ধরনের মূল্যবোধ চাই সমাজে, এবং কীভাবে বিপদের মুখে আমাদের আচরণ আমাদের পরিচয় তৈরি করে।

তাই আমি মনে করি, শুধুমাত্র
রক্ত নয়, নৈতিকতাই মানুষের প্রকৃত সম্পর্ক।

আলোচিত ঘটনা দুটি আগামী জাতীয় নির্বাচনে ভোটারদের সিদ্ধান্ত দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমি মনে করি।

সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে এক পিতার সন্তানের দিকে না ফিরে পালিয়ে যাওয়া এবং অন্যদিকে এক মাদ্রাসা শিক্ষকের জীবন বাজি রেখে শিক্ষার্থীদের রক্ষা করার ঘটনায় সমাজে নৈতিকতার প্রকৃত শক্তি নতুনভাবে উন্মোচিত হয়েছে।

সম্পর্কের চেয়েও নৈতিকতা যে অধিক মূল্যবান—এই বাস্তবতা আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

ঠিক তেমনই নির্বাচনের ক্ষেত্রেও নৈতিকতা-শূন্য, চাঁদাবাজ, দুর্নীতিবাজ, টেন্ডারবাজ, দখলবাজ কিংবা মাদক–সন্ত্রাসের পৃষ্ঠপোষকদের ভোট না দেওয়া সুবিবেচনার পরিচয় হবে।

নৈতিকতাহীন ব্যক্তিকে ক্ষমতায় বসালে সমাজের নিরাপত্তা, উন্নয়ন ও তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

এবারের ব্যালটে যুক্ত হয়েছে ‘না ভোট’ দেওয়ার সুযোগ। কোনো এলাকায় উপযুক্ত ও নৈতিক প্রার্থী না থাকলে ভোটাররা এই বিকল্পের মাধ্যমে অসৎ ও অনৈতিক প্রার্থীদের প্রত্যাখ্যান করতে পারবেন। এতে গণতন্ত্র আরও শক্তিশালী হবে এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি নিরাপদ ও উন্নত বাংলাদেশ গড়ে উঠবে।

পরিশেষে দেশের প্রতিটি ভোটারের কাছে আমার সবিনয় অনুরোধ,
আপনার সন্তান,নাতি-পুতি অর্থাৎ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তার স্বার্থে, নিরাপদ সমাজ ও উন্নয়নের স্বার্থে
নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগের সময় নৈতিকতার মূল্যবোধকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিন।

লেখক:সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, ঢাকা।

 

শেয়ার করুন
Share on Facebook
Facebook
Pin on Pinterest
Pinterest
Tweet about this on Twitter
Twitter
Share on LinkedIn
Linkedin