আজ মঙ্গলবার, ১৮ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৩রা অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২৭শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরি
আজ মঙ্গলবার, ১৮ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৩রা অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২৭শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরি

নির্বাচিত সরকার ছাড়া মূল্যস্ফীতির সমাধান কঠিন: অর্থ উপদেষ্টা

 

 

উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার অন্যতম কারণ হিসেবে চাঁদাবাজিকে দায়ী করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ।

 

বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, চাঁদাবাজির কারণে পণ্য পরিবহনের ব্যয় কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা সরাসরি বাজারদরে প্রভাব ফেলছে। মহাস্থানগড় থেকে ঢাকায় একটি ট্রাক পণ্য আনতে স্বাভাবিক ভাড়া পাঁচ হাজার টাকা হলেও চাঁদাবাজির কারণে সেটি ১২ হাজার টাকা হয়ে যাচ্ছে।

 

তিনি আরও উল্লেখ করেন, আগে যারা চাঁদাবাজি করতেন, তারা এখনো সক্রিয়, পাশাপাশি নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মীরাও এতে যুক্ত হয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ের চাঁদাবাজির প্রভাবও অর্থনীতির ওপর পড়ছে।

 

ব্যাংকিং খাতের চরম দুরবস্থা

 

সাক্ষাৎকারে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, দেশের ব্যাংকিং খাত নজিরবিহীন দুরবস্থার মধ্যে রয়েছে। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনৈতিকতায়ও গুরুতর অনিয়ম হয়েছে। ঋণখেলাপির সংখ্যা বেড়েছে, হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে।

 

তিনি জানান, ব্যাংকগুলো থেকে বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ীরা বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণ নিয়েছে, যা ফেরত আসার সম্ভাবনা খুবই কম। উদাহরণ হিসেবে তিনি বেক্সিমকোর নাম উল্লেখ করেন, যাদের জনতা ব্যাংক থেকে নেয়া ২৩ হাজার কোটি টাকার মধ্যে মাত্র চার হাজার ৫০০ কোটি টাকার সম্পদ চিহ্নিত করা গেছে।

 

ঋণ আদায়ে কঠোর ব্যবস্থা নিতে সরকার নতুন একটি কমিটি গঠন করেছে বলে জানান তিনি। তবে অর্থের অভাবে সংকটে পড়া কিছু ব্যাংককে ইতোমধ্যে ২২ হাজার কোটি টাকার সহায়তা দেওয়া হয়েছে।

 

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে চ্যালেঞ্জ

 

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, এটি দীর্ঘদিনের সংকট। গত দুই-তিন বছর ধরে বাজারে প্রচুর অর্থ প্রবাহ হয়েছে, ফলে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। বিশেষ করে মেগা প্রকল্পগুলোর বিনিয়োগের রিটার্ন আসতে দেরি হয়, ফলে অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি হয়।

 

তিনি আরও বলেন, “খাদ্যদ্রব্যের দাম কিছুটা বেড়েছে, তবে নন-ফুড খাতে মূল্যস্ফীতি কমেছে। আমরা সরবরাহ চেইন ঠিক রাখার চেষ্টা করছি, কিন্তু এটি ভেঙে পড়েছে।”

 

তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, আগামী জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতির হার ৮ শতাংশের নিচে নামানো সম্ভব হবে, তবে একেবারে ৫-৬ শতাংশে নামিয়ে আনা কঠিন।

 

কর নীতিতে পরিবর্তন ও করজাল বৃদ্ধি

 

কর আদায়ের ক্ষেত্রে ডিজিটাল পদ্ধতির গুরুত্ব তুলে ধরে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, “অনেক ব্যবসায়ী ঠিকভাবে কর দেন না, বরং কর ফাঁকি দিয়ে সেটেল করে ফেলেন। এটি নিয়ন্ত্রণে এনবিআরকে আরও শক্তিশালী করা হচ্ছে।”

 

তিনি জানান, দেশে করদাতার সংখ্যা বাড়াতে করনীতি ও কর প্রশাসনকে পৃথক করা হবে। ব্যক্তিগত আয়কর অনলাইনে করা হয়েছে, তবে কোম্পানির কর আদায়ে এখনও জটিলতা রয়ে গেছে।

 

বেকারির বিস্কিটের মতো কিছু পণ্যের দাম বাড়লেও তিনি বলেন, “বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম সর্বনিম্ন করহারযুক্ত দেশ। আমরা এটি যুক্তিসঙ্গত পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাই।”

 

রকারি ব্যয় কমানো ও বিনিয়োগ আকর্ষণ

 

সরকার পরিচালনায় ব্যয় কমানোর বিষয়ে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, নতুন গাড়ি কেনা, বড় অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়ন আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। শুধু পুলিশ ও জরুরি বিভাগের জন্য প্রয়োজনীয় গাড়ি কেনার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে।

 

বিনিয়োগ আকর্ষণে সরকারের পদক্ষেপ সম্পর্কে তিনি বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে বেশ কিছু সংস্কার করা হচ্ছে। বিশেষ করে জমির অধিকার নিশ্চিত করা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমানো এবং নীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হচ্ছে।

 

পুঁজিবাজারে আস্থা ফেরানোর উদ্যোগ

 

দেশের পুঁজিবাজারের অস্থিরতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শেয়ারবাজারে কারসাজির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষায় নতুন আইপিও আনার পরিকল্পনাও রয়েছে।

 

বিদেশি ঋণ ও মুদ্রা নীতি

 

দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমরা এলসি বাবদ সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের দেনা পেয়েছিলাম, এখন তা ৫০০ মিলিয়নে নেমে এসেছে।”

 

তিনি আরও বলেন, মুদ্রার বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার মতো সংকটে পড়বে না।

 

আয়ের বৈষম্য দূরীকরণ ও কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের প্রত্যাশা

 

সাক্ষাৎকারের শেষভাগে তিনি বলেন, “আমাদের প্রবৃদ্ধি হয়েছে, কিন্তু এর সুফল সবার কাছে যায়নি। আয়ের বৈষম্য যেমন রয়েছে, সম্পদের বৈষম্য আরও বেশি। এটি বন্ধ করতে হবে।”

 

তিনি বলেন, “আমরা এমন একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্র চাই, যেখানে শুধুমাত্র খাদ্য নয়, স্বাস্থ্য ও জীবনমানের উন্নতি নিশ্চিত হবে। এটি করা সম্ভব।” -বিবিসি বাংলা

 

শেয়ার করুন
Share on Facebook
Facebook
Pin on Pinterest
Pinterest
Tweet about this on Twitter
Twitter
Share on LinkedIn
Linkedin