
প্রতারণা ও অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা আত্মসাত ও পাচারের অভিযোগে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড’র অডিট কমিটির চেয়ারম্যান এম.এ.খালেক, সাবেক চেয়ারম্যান মো: নজরুল ইসলাম এবং সাবেক পরিচালক কে.এম খালেদ এর বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হচ্ছে। সবচেয়ে বেশী মামলা হয়েছে এম.এ.খালেক এর বিরুদ্ধে। গত ৩ বছরে খালেকের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানা, সিএমএম কোর্ট ও হাইকোর্টে প্রায় দুই ডজন মামলা হয়েছে। সর্বশেষ গত ৮ মার্চ প্রায় ৯১ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তারা ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থাকছেন। গুলশান ও বারিধারায় শত কোটি টাকা দামের আলিশান বাড়ীতে থাকছেন। লেটেষ্ট ব্র্যান্ডের বিএমডব্লিউ, মার্সিডিজ ও প্রাডো গাড়ীতে করে নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সর্বত্র। যেন কোনো কিছুই হয়নি। খালেকের বিরুদ্ধে হাজার কোটি টাকা আত্মসাত ও পাচারের পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত রাজনৈতিক সংগঠন জামায়াতে ইসলামীকে পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ রয়েছে। দেশের একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। ফারইস্ট ইসলামী লাইফ’র সাবেক পরিচালক এবং বিতর্কিত গেটকো গ্রুপের চেয়ারম্যান কে.এম খালেদ ও ফারইস্ট লাইফ’র সাবেক চেয়ারম্যান মো: নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে গুরুতর অনৈতিক-অসামাজিক কর্মকান্ডের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। এসব বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য তাদের মুঠো ফোনে যোগাযোগ করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে আমেরিকান চেম্বার ইন বাংলাদেশ’র প্রেসিডেন্ট সৈয়দ এরশাদ আহমেদ আমার দিন’কে বলেন,‘এ ধরণের দুর্নীতির ঘটনাবলী শুধু যে দেশের ইমেজ ক্ষুন্ন করছে তা নয়। পাশাপাশি বিদেশী বিনিয়োগও বাধাগ্রস্ত করছে।’ আর ইকোনোমিক রিচার্স গ্রুপ (ইআরজি)’র নির্বাহী পরিচালক ড. সাজ্জাদ জহির এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় বলেন,‘রেগুলেটরী অথরিটির চোখের সামনে এত বড় ঘটনা কি করে ঘটলো। এ ঘটনার প্রাথমিক দায় ইডরার ওপরই পড়ে।’
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) গভীর অনুসন্ধান ও তদন্তে দুর্নীতির মাধ্যমে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির প্রায় ৯১ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার পর্যাপ্ত প্রমাণ মেলায় ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড’র সাবেক চেয়ারম্যান মো: নজরুল ইসলাম, সাবেক পরিচালক কেএম খালেদ এবং অডিট কমিটির চেয়ারম্যান এম.এ.খালেক ও সাবেক কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। একটি মামলায় প্রায় ৭১ কোটি এবং অপর একটি মামলায় ২০ কোটি টাকা আত্মসাত ও পাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে। গত ৮ মার্চ সিএমএম কোর্টে দায়েরকৃত মামলা দুটির বাদী হয়েছেন দুদকের সহকারি পরিচালক শারিকা ইসলাম ও সহকারি পরিচালক বায়েজিদুর রহমান খান। মামলার অপর আসামিরা হলেন, এম এ খালেকের ছেলে ও সাবেক পরিচালক শাহরিয়ার খালেদ, মো: মিজানুর রহমান, ফরিদউদ্দিন এফসিএ, আসাদ খান, কোম্পানি সেক্রেটারি সৈয়দ আব্দুল আজিজ এবং বরখাস্তকৃত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হেমায়েত উল্যাহ। দুদকের সিনিয়র উপ-পরিচালক ড. মোহাম্মদ জহিরুল হুদার নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি টিম বেশ কিছু দিন ধরে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ভয়ংকর সব অনিয়ম-দুর্নীতি ও লুটপাটের বিষয়টি তদন্ত করছেন। অপর দুই সদস্য হলেন, সহকারি পরিচালক শারিকা ইসলাম ও সহকারি পরিচালক বায়েজিদুর রহমান খান। অনুসন্ধানের বিষয়ে দুদকের সিনিয়র উপ-পরিচালক ড. মোহাম্মদ জহিরুল হুদা আমার দিন’কে বলেন, ‘কয়েক মাস আগেই আমি তদন্তের দায়িত্ব পাই। তবে করোনার বিধি-নিষেধের কারণে কাজে কিছুটা শিথিলতা ছিল। এখন আমরা পূর্ণোদ্যমে কাজ শুরু করেছি।’
এ বিষয়ে ট্রান্সফারেন্সী ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশে (টিআইবি)‘র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি আমার দিন’কে বলেন,‘দুর্নীতিবাজদের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত না করার ফলে সমাজে এর বিস্তার দিন দিন বেড়েই চলছে। তিনি বলেন,‘আমাদের এখানে দুর্নীতিবাজরা অত্যন্ত প্রভাবশলী হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে বিচার কাজ বিঘ্নিত হয়।’এজন্য দুর্নীতিবাজদের বিচারে একটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘সর্বব্যাপী দুর্নীতির গ্রাস ও মামলার দীর্ঘসূত্রিতা বন্ধে সরকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে পারে। আমাদের সরকার প্রধান প্রায়ই দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’র কথা বলেন যা পৃথিবীর কোনো দেশের সরকার বলে না। কাজেই সরকারের এই সদিচ্ছার প্রতিফলনে যেসব ব্যক্তি ও সংস্থা কাজ করেন তারা যদি এগিয়ে না আসেন তাহলে দুর্নীতির বিস্তার বন্ধ হবে না। সবচেয়ে জরুরী হচ্ছে দুর্নীতিবাজদের শাস্তি নিশ্চিতকরণ।’
দুদকের দীর্ঘ অনুসন্ধান প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, প্রাপ্ত রেকর্ডপত্রের ভিত্তিতে পারষ্পরিক যোগসাজশে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিঃ এর ১৫৮ তম পর্ষদ সভার কার্য বিবরণীর ভুয়া সার-সংক্ষেপ সৃজন করে ওই সার-সংক্ষেপের বরাত দিয়ে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিঃ এর ফরেন এক্সচেঞ্জ শাখার, মতিঝিলে ‘এফআইএলআইসিএল’র নামে রক্ষিত ২২টি এমটিডিআর জামানত রেখে আত্মসাতের উদ্দেশ্যে পিএফআই প্রপার্টিজ লিঃকে ৪০ কোটি টাকার ঋণ/বিনিয়োগ সুবিধা দেয়ার মাধ্যমে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ৭০ কোটি ৮৩ লাখ ৬৯ হাজার ৪শ’৩৯ টাকা আত্মসাত করেন। যা ১৮৬০ সালের দন্ডবিধি ১০৯ ও ৪০৯ ধারা এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন,২০১২ এর ৪(২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এমএ খালেক, কেএম খালেদ,ফরিদউদ্দিন,মিজানুর রহমান,আসাদ খান এবং এমএ খালেকের পুত্র শাহরিয়ার খালেদ একই সঙ্গে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লি: এবং ‘প্রাইম এশিয়া ফাউন্ডেশন’র পরিচালনা পর্ষদ সদস্য। সুতরাং ফারইস্ট’র চেয়ারম্যান মো: নজরুল ইসলাম,অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হেমায়তে উল্যাহ, কোম্পানি সেক্রেটারি সৈয়দ আব্দুল আজিজ এবং এফআইএলআইসিএল ও প্রাইম এশিয়া ফাউন্ডেশনের পরিচালক এম.এ.খালেক, কেএম খারেদ, ফরিদউদ্দিন, মিজানুর রহমান,আসাদ খান ও শাহরিয়ার খালেদ পরষ্পর যোগসাজশের মাধ্যমে আত্মসাতের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠানটির ৪০ কোটি টাকা তাদেরই মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান পি.এফআই প্রোপার্টিজ লি:কে ঋণ দিয়েছেন। পরবর্তীতে এ ঋণ পরিশোধ না করে আত্মসাত করেন। এর ফলে ফারইস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্স এর মোট ৭০ কোটি ৮৩ লাখ ৬৯ হাজার ৩৪৯ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। অন্যদিকে খালেক-খালেদ,নজরুল গং পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত ফারইস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্সে থেকে গ্রাহকদের ২ হাজার ১২৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে বলে গত বছরের ডিসেম্বরে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) বিশেষ নিরীক্ষায় ধরা পড়ে। কোম্পানির মালিকরা গত এক দশকে এই টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচার করে। কমিশনের প্রতিবেদনে সকল লেনদেনকে সুস্পষ্ট মানি লন্ডারিং অপরাধ উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনটি অর্থ মন্ত্রণালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এবং সিআইডিকে দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফারইস্ট লাইফের সাবেক চেয়ারম্যান মোঃ নজরুল ইসলাম, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ হেময়েত উল্লাহ এবং পরিচালক এম এ খালেক যৌথভাবে এই টাকা আত্মসাৎ করেছে। এর জন্য সংশ্লিষ্ট পক্ষটি নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার জন্য জাল নথি পর্যন্ত করেছে। এর মধ্যমে ২ হাজার ১২৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। একই সাথে টাকাগুলো তারা বিদেশে পাচার করেছে। তারা তিনজন যৌথভাবে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে। তবে আন্যরাও জড়িত থাকতে পারে।
সূত্র মতে, ২ হাজার ১২৫ কোটি টাকার মধ্যে ৮৫৪ কোটি টাকা বেআইনি জমি অধিগ্রহণ, তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কোম্পানিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে ৬৫৯.৬৭ কোটি টাকা এবং কোম্পানিগুলোর মুদারাবা মেয়াদী আমানতের বিপরীতে ব্যাংক ঋণ নিয়ে ৪২১ কোটি টাকা এবং দুটি ভূয়া সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ১৯২ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে মালিকরা।তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই টাকা ৩০ জুন,২০২১ পর্যন্ত সরকারি বন্ডে বিনিয়োগ করলে কমপক্ষে ১০ শতাংশ মুনাফা পেত। সেই হিসেবে কোন ধনরণের ঝুঁকি ছাড়া এই টাকার পরিমাণ হতো ৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা।এ বিষয়ে বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবায়াত-উল-ইসলাম বলেন, ফারইস্ট লাইফের বিরুদ্ধে বিএসইসি একটি তদন্ত করেছে। সেখানে বড় ধরণের অনিয়ম ধরা পড়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনটি ইতোমধ্যে আরও কিছু নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে দেওয়া হয়েছে।তিন আরও বলেন, মালিকদের অপকর্মের কারণে গত ৯ আগস্ট কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে কোম্পানিটিতে ১০ জন স্বতন্ত্র পরিচালক দেওয়া হয়েছে।প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,ফারইস্ট লাইফের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ২০১০ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছে। তার মেয়াদে ধারাবাহিক আর্থিক অপরাধ এবং অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটেছে। সাবেক পর্ষদ কোম্পানির নামে ১২টি জায়গায় জমি ক্রয় করেছে। প্রত্যেকটি জায়গা অস্বাভাবিক উচ্চ মূল্যে ক্রয় করেছে। এর মাধ্যমে মোট ৮৫৮ কোটি টাকা আত্মসাত করেছে।প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে ১২ মে কোম্পানি সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম তার শ্বশুর মোঃ মফিজুল ইসলাম ও শ্যালক মোঃ সেলিম মাহমুদের কাছ থেকে ২৮ দশমিক ৫০ ডিসিমেল জমি ক্রয় করেছে। এর জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭২ কোটি টাকা। অথচ ২০১৪ সালের ৮ জুলাই তারা এই জমি মাত্র ১৯ কোটি ৫৮ লাখ টাকায় ক্রয় করেছে।জমি কেনাবেচার মাধ্যমে চেয়ারম্যানের শ্বশুর ও শ্যালক ১৯৮ কোটি টাকার বেশি অর্থ ব্যক্তিগতভাবে লাভ করেন। ফারইস্ট লাইফের কাছ থেকে দাম বুঝে পাওয়ার পরই উপহার হিসেবে ১১৫ কোটি টাকা নজরুল ইসলামের স্ত্রী তসলিমা ইসলামের অ্যাকাউন্টে জমা দেন। আবার তসলিমা ইসলামও তার স্বামীকে ৫০ কোটি টাকা উপহার দেন। বিশাল অঙ্কের এ উপহারের তথ্য তারা ওই বছরের আয়কর নথিতেও উল্লেখ করেন।এছাড়াও, ২০১৪ সালের ৩ মার্চ নজরুল ইসলামের দুই ভাই আজহার খান ও সোহেল খানের কাছ থেকে একটি পুরানো ভবনসহ ৩৩.৫৬ ডেসিমেল জমি ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও তারা নজরুল ইসলামের ব্যবসায়িক অংশীদার। এর জন্য ব্যয় ধরা হয় ২০৭.৩৬ কোটি টাকা।কিন্তু ২০১৪ সালের শুরুতে আজহার খান ১২.৮৫ কোটি টাকায় ১৫.৩ ডেসিমেল এবং মোঃ সোহেল খান ৮.৭০ কোটি টাকায় বাকী ১৮.২৬ ডেসিমেল জমি ক্রয় করে। এই জমি তারা ফারইস্ট লাইফের কাছে উচ্চ মূল্যে বিক্রি করেছে।বিএসইসি রিপোর্টে বলা হয়েছে, দুটি সংশ্লিষ্ট পক্ষের লেনদেনের মাধ্যমে ফারইস্ট লাইফের ৪০৬.৯৪ কোটি টাকা নিজের করে নিয়েছে সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম। এই টাকা তিনি দেশের বাহিরে পাচার করেছে।বিষয়টি নিয়ে সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম, উদ্যোক্তা এমএ খালেক এবং সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হেমায়েত উল্লাহকে বারবার ফোন করা হয়। তাদের সকলের ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। অন্য কোনো উপায়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে কোম্পানি সচিব মাহামুদুল হাসান বলেন,বিএসইসির তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে আমরা কিছু জানিনা। তাই এই বিষয়ে মন্তব্য করতে পারে না।ফারইস্ট লাইফ ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের মাঝে ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক এবং ইউনিয়ন ব্যাংকে মোট ৩৬৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা আমানত রাখে। এর বিপরীতে উদ্যোক্তা এমএ খালেক ৩১২ কোটি ৯৮ লাখ টাকা ঋণ নেন এবং তিনি খেলাপি হন। পরে ওই তিন ব্যাংক ফারইস্ট লাইফের আমানত দ্বারা ওই ঋণ সমন্বয় করেছে।বিএসইসির প্রতিবেদনে এসব ঘটনায় ফারইস্ট লাইফের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম, উদ্যোক্তা এমএ খালেক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক হেমায়েত উল্লাহর বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ এনেছে। এতে বলা হয়েছে, তাদের পারস্পরিক যোগসাজশ ও পরিকল্পনায় অর্থ লোপাট হয়েছে। অস্বাভাবিক দামে জমি কেনাবেচার বাইরে তারা নিজেদের স্বার্থসংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়ে শত শত কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি সাধন করেছেন।প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোম্পানিটির নামে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকে মোট ১৩টি মুদারাবা মেয়াদী আমানত (এমটিডিআর)। এগুলো ছিলো পরিচালকদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। এই হিসাব খোলার জন্য তারা পর্ষদ সভার রেজুলেশন জাল করেছে। এর মাধ্যমে কোম্পানিটির পরিচালকরা ব্যাংকগুলো থেকে অনৈতিক ঋণ সুবিধা নিয়েছে। এর জন্য সহযোগিতা করেছে কোম্পানির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক। যখন তারা ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়, ওই সময়ে ব্যাংকগুলো মুদারাবা মেয়াদী আমানত (এমটিডিআর) বাতিল করে দেয়৷যেমন, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে ফারইস্টের গচ্ছিত আমানতকে তৃতীয় পক্ষের জামানত হিসেবে ব্যবহার করে নিজের স্বার্থসংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠান পিএফআই সিকিউরিটিজের নামে ২০১২ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মোট ১৩৬ কোটি টাকা ঋণ নেন এমএ খালেক। ব্রোকারেজ হাউসটি ঋণ পরিশোধ না করায় ফারইস্ট লাইফের আমানত থেকে ১৮৫ কোটি টাকা কেটে নিয়েছে ব্যাংক।একইভাবে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে এমএ খালেকের প্রাইমএশিয়া ইউনিভার্সিটি, পিএফআই প্রপার্টিস, মিথিলা টেক্সটাইল, মিথিলা প্রপার্টিস এবং আজাদ অটোমোবাইলসের নামে নেওয়া ২১৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েও তা পরিশোধ করেনি। কিন্তু এসব ঋণের বিপরীতে ইসলামী ব্যাংক, এসআইবিএল এবং ইউনিয়ন ব্যাংক ফারইস্ট লাইফের আমানত থেকে ২৯৩ কোটি টাকা সুদে-আসলে কেটে নিয়েছে। এভাবে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের ঋণের জামানত দিয়ে সেই ঋণ খেলাপি হয়ে পড়লে ব্যাংকগুলো বীমা কোম্পানিটির আমানত থেকে অর্থ কেটে নিয়েছে। এভাবে ফারইস্টের মোট লোকসান হয়েছে ৯৭৭ কোটি টাকার বেশি। দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে খালেক-নজরুল কানাডা ও আমেরিকায় বিশাল সাম্রজ্য গড়ে তুলেছেন বলে জানা গেছে। এদিকে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স’র লুটপাটের ঘটনায় সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ও সাবেক অডিট কমিটির চেয়ারম্যানে এমএ খালেকের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে উচ্চ আদালত। ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ৭জন শেয়ার হোল্ডারের করা মামলার প্রেক্ষিতে বিচারপতি কে.এম কামরুল কাদেরের একক বেঞ্চ সম্প্রতি এ আদেশ দিয়েছেন।