আজ মঙ্গলবার, ১৮ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৩রা অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২৭শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরি
আজ মঙ্গলবার, ১৮ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৩রা অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২৭শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরি

নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় আহতরা,এখনো চিকিৎসাধীন ১৫৩ জন

 

গত জুলাই-আগস্টে দেশ জুড়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে দেড় হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। আন্দোলনে আহতদের মধ্যে শুধু ঢাকার চারটি হাসপাতালেই চিকিৎসা নিয়েছেন অন্তত ৪ হাজার ৭৫০ জন মানুষ। এদের মধ্যে এখনো ১৫৩ জন চিকিৎসা নিচ্ছেন।

সরজমিন রাজধানীর শেরে বাংলা নগরের জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (পঙ্গু হাসপাতাল), শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে,  বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত দেড় শতাধিক রোগী এখনো চিকিৎসা নিচ্ছেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী সেবা নিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহত হয়ে আমাদের হাসপাতালে এখন পর্যন্ত ২৭শ’ রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। এদের মধ্যে হাসপাতালের ইমার্জেন্সি থেকে চিকিৎসাসেবা নিয়ে অনেকেই বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। কাউকে অনান্য হাসপাতালে রেফার করা হয়েছে। আর গুরুতর ৮৯০ জনকে বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। বর্তমানে এখনো ৩০ জন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।

এদিকে জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে চোখে গুলিবিদ্ধ ও আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে সাড়ে ৭শ’ জন চিকিৎসা নিয়েছেন জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল থেকে। তাদের কেউ একচোখ হারিয়েছেন। কেউ আবার সারাজীবনের মতো নিজের দুই চোখেরই দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন। এসব রোগীদের দেখভালের দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক ডা. জাকিয়া সুলতানা বলেন, আন্দোলনে আহত হয়ে এ পর্যন্ত আমাদের এখানে সাড়ে ৭০০ মানুষ চিকিৎসা নিয়েছেন। এ ছাড়াও ৫৫০ জন আমাদের হাসপাতাল থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। ২২৫ জনকে সেকেন্ডারি অপারেশন করা হয়েছে। বর্তমানে এখনো হাসপাতালের ৪ তলার স্পেশালাইজড ডেডিকেটেড ইউনিটে ৩৭ জন ভর্তি রয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা এসব রোগীদের জন্য বাইরের দেশ থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এনে সেবা দিয়েছি এবং দিচ্ছি। আজকেও (শনিবার) নেপালের চিকৎসক দলের কাছে আন্দোলনে চোখে গুলিবিদ্ধ ও আঘাতপ্রাপ্ত অন্তত ৭০ জনের বেশি চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে চট্টগ্রামের সমজান মিয়া একজন। এই নির্মাণ শ্রমিক বলেন, চট্টগ্রামের নিউমার্কেট এলাকায় একটি বহুতল ভবনে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছিলেন তিনি। গত ৫ই আগস্ট সরকার পতনের পর হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। আমি অবস্থা বেগতিক দেখে বাসায় ফিরে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ পুলিশ রাস্তার মানুষদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া শুরু করে। সেই শটগানের ছররা গুলি এসে আমার চোখসহ শরীরে বিভিন্ন জায়গায় লাগে। আমি তখনো বুঝতে পারিনি আমার চোখের মধ্যে গুলি ঢুকে গেছে। গ্রেপ্তারের ভয়ে প্রথমে আমাকে তখন বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর একটি স্থানীয় হাসপাতালে যাই। সেখান থেকে কোনো চিকিৎসা দেয়া হয় না। এরপর ফৌজদারহাটের একটি মেডিকেলে যাই। সেখান থেকে সাধারণ চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। এরপর গত ৯ই আগস্ট আমি চট্টগ্রাম মেডিকেলে যাই। সেখানে একেকজন ডাক্তার একেকবার এসে আমার চোখের ছবি দেখে চলে। এর একদিন পর আমাকে জানানো হয় চট্টগ্রামে মেডিকেলে আমার চিকিৎসা হবে না। ঢাকায় যেতে হবে। পরে আমি ঢাকায় এসে এখানে ভর্তি হই। এখানে আসার পর আমার চোখে একবার অপারেশন হয়েছে কিন্তু এখনো গুলি বের হয়নি। ডাক্তার জানিয়েছেন, আমি কোনোদিন আর ডান চোখে দেখতে পারবো না।

শেরে বাংলা নগরের আরেক হাসপাতাল শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসাসেবা দেয়ার জন্য ডেডিকেটেড ইউনিট খোলা হয়। সেখানকার ৪ তলার তিনটি ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিয়েছেন ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহত অন্তত ৫ শতাধিক। তাদের কারও পায়ে গুলি লেগেছে, কারও হাতে, কারও পেটে। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. শফিউর রহমান বলেন, আন্দোলনে আহত হয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসে  আমাদের হাসপাতালে ৫ শতাধিক মানুষ ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। এদের বেশির ভাগই ছাড়পত্র নিয়ে বাড়িতে ফিরেছেন। তবে এখনো ৪২১ নম্বর ওয়ার্ডে ৭ জন রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

অপরদিকে আন্দোলনে আহতদের মধ্যে হাড়ভাঙা রোগীরা চিকিৎসা নিয়েছেন জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) বা পঙ্গু হাসপাতালে। সেখানকার ক্যাজুয়ালিটি-১, ক্যাজুয়ালিটি-২ সহ বিভিন্ন ওয়ার্ডে বিক্ষিপ্তভাবে আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা দেয়া হলেও বর্তমানে হাসপাতালটির তিনতলা ও চারতলায় এসব রোগীদের জন্য বিশেষায়িত ওয়ার্ড খোলা হয়েছে। হাসপতালের উপ-পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. বদিউজ্জামান বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহত হয়ে আমাদের হাসপাতালে ৮ শতাধিক মানুষ চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে অন্তত ২১ জনের অঙ্গহানি হয়েছে। এখনো ৭৯ জন আমাদের হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন।  তিনি বলেন, আন্দোলনে আহতদের মধ্যে বেশির ভাগেরই মাল্টিপল ইঞ্জুরি রয়েছে। হাড় ভাঙার সঙ্গে তাদের শরীরের মাংসও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা আমাদের সাধ্যমতো সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। পঙ্গু হাসপাতালের ৩ তলার বি-ওয়ার্ডে চিকিৎসা নেয়াদের মধ্যে মাদ্রাসাছাত্র সাদ আব্দুল্লাহ একজন। গত ৭ই আগস্ট থেকে তিনি হাসপাতালটিতে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। সাদ বলেন, গত ৫ই আগস্ট দুপুরে হাসিনা সরকারের পতনের খবরে সকলে যখন আনন্দ করছিলেন, সে সময় আমিও মিরপুর এলাকায় মিছিল দেখতে গিয়েছিলাম। মিছিলটি মিরপুর-১ থেকে ২ নম্বরের দিকে এগুতেই হঠাৎ পুলিশ আমাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া শুরু করে। তখন ভয়ে আমি ওভারব্রিজের উপর ওঠে পড়ি। পুলিশ তখন ওই ব্রিজের উপর উঠে আমার পায়ে গুলি করে। সেই গুলিতে আমার বাম পায়ের হাঁটুর হাড় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পরে কয়েকজন মিলে আমাকে পাশের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে আমার পায়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে ইস্ট-ওয়েস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নামে আরেক বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলে। দুইদিন থাকার পর সেখানকার চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে না পেরে এই হাসপাতালে চলে আসি। তখন থেকে এখানেই ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছি। সাদ বলেন, পায়ে স্টিলের খাঁচা লাগানো। হাঁটতেও পারি না, চলতেও পারি না।  বিছানায় খাওয়া, বিছানাতেই সব।  কবে আমি এ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবো তারও ঠিক নেই। তিনি বলেন, চিকিৎসকেরা বলেছেন, বছরখানেক পর অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে পায়ের রড খোলা হলেও আগের মতো স্বাভাবিকভাবে আর চলতে পারবো না। নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় আছি।

 

শেয়ার করুন
Share on Facebook
Facebook
Pin on Pinterest
Pinterest
Tweet about this on Twitter
Twitter
Share on LinkedIn
Linkedin